মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলী প্রতিষ্ঠিত দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশন (ডিএমসিএল) সম্পত্তি দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে ডিএমসিল-এর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি বিরোধে জড়িয়েছে জামায়াত। বিজয়নগরস্থ আলরাজি ভবনে দিগন্ত টেলিভিশনের দুটি ফ্লোর ও দিগন্ত টিভির লাইসেন্স ক্রয় এবং নয়া দিগন্তে জামায়াতের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই বিরোধ তীব্র রূপ নিয়েছে।
এরই অংশ হিসেবে শনিবার (৩ ফেব্রুয়ারি) নয়া দিগন্ত পত্রিকার অফিস দখলে নিয়েছে জামায়াত। পুরো দিগন্ত মিডিয়া ও এর সম্পত্তিকে নিজেদের কবজায় নেয়ার জন্য জামায়াত নেতারা মিডিয়া করপোরেশনের বর্তমান চেয়ারম্যান শিব্বির মাহমুদ ও ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার জাকির হোসেনকে নানাভাবে চাপ দিয়ে আসছে বলে জানা গেছে। তাদেরকে পদত্যাগ করার জন্য নানাভাবে হুমকী-ধমকী দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। অবশ্য জানার জন্য শিব্বির মাহমুদসহ নয়া দিগন্তের একাধিক পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করা হলে- তারা এসব ব্যাপারে মিডিয়ার সাথে কোন কথা বলতে রাজি হননি।
জানা যায়, এস আলম গ্রুপ, বিআরবি ক্যাবল, আকিজ গ্রুপ, আমান গ্রুপ, ইউনুস গ্রুপ, কোহিনূর ক্যামিকেলস, বিডি ফুডসহ প্রায় ৮ হাজার শেয়ার হোল্ডারের সোয়া দুইশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনে। প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- নয়া দিগন্ত পত্রিকা, জুরাইনে নিজস্ব কয়েক বিঘা জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত প্রিন্টিং প্রেস, বিজয় নগরে আল রাজি কমপ্লেক্সে দুটি ফ্লোর ও দিগন্ত টেলিভিশনের লাইসেন্স।
নয়া দিগন্ত দখল : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবার সকাল ৯টার দিকে বহিরাগত জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের নিয়ে নয়া দিগন্তে জামায়াতের কট্টরপন্থী একটি গ্রুপ ইত্তেফাক মোড়ে অবস্থিত পত্রিকাটির অফিসের দখল নেয়। একইসঙ্গে ডিএমসিএল এর পক্ষে পত্রিকার প্রকাশের দায়িত্বে থাকা শামসুল হুদাকে দিয়ে চিঠি ইস্যু করিয়ে পত্রিকার পরিচালনার একক দায়িত্ব দাবি করানোর চিঠি ইস্যু করা হয়। এরপরই পত্রিকার সম্পাদককে দিয়ে কিছু চিঠি ইস্যু করিয়ে পত্রিকায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন ও উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক কর্মচারিদের পত্রিকা থেকে অব্যাহতি দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। পত্রিকার স্বার্থবিরোধী কাজের অভিযোগে গত বছরের মে মাসে পত্রিকা থেকে বরখাস্ত হওয়া মাসুমুর রহমাান খলিলীকে পত্রিকায় ফিরিয়ে এনে বর্তমানে জামায়াত-শিবির ক্যাডার পরিবেষ্টিত অবস্থায় পত্রিকাটির অফিস পরিচালিত করা হচ্ছে।
দিগন্ত টিভির লাইসেন্স ও ফ্লোর ক্রয় নিয়ে বিরোধ : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নয়া দিগন্ত পত্রিকার আর্থিক সংকটকে পুঁজি করে জামায়াত সুকৌশলে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে জামায়াতের কেন্দ্রীয় বায়তুলমাল সম্পাদক শাহাবুদ্দিনের নামে বিজয় নগরস্থ আল রাজি কমপ্লেক্সের দুটি সুবিশাল ফ্লোর ও দিগন্ত টিভির যন্ত্রাংশসহ লাইসেন্স মাত্র ২০ কোটি টাকা দামে ক্রয়ের একটি চুক্তি করে। তখন ডিএমসিএল এর এমডির দায়িত্বে ছিলেন ইবনে সীনা ট্রাস্টের পরিচালক কাজী হারুনুর রশীদ। চুক্তিনামায় কাজী হারুনের পাশাপাশি সাক্ষী হিসেবে জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের আমীর নুরুল ইসলাম বুলবুল ও দক্ষিনের আমীর সেলিম উদ্দিনের স্বাক্ষর রয়েছে। চুক্তিতে ২০২৬ সালের মধ্যে কিস্তিতে টাকা পরিশোধের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু জামায়াত নয়া দিগন্তসহ পুরো মিডিয়া করপোরেশনের একক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত বছরের জুন মাস থেকে কিস্তির টাকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। এতে নয়া দিগন্ত পরিচালনায় আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে ডিএমসিএল কতৃপক্ষ। এরই সুযোগ নিয়েই মূলত: সর্বশেষ নয়া দিগন্ত পত্রিকাটি দলীয় কট্টরপন্থী সাংবাদিকদের দিয়ে একক দখলে নেয় জামায়াত।
জানা যায়, নয়া দিগন্ত দখলের পর এখন ডিএমসিএল এর সকল সম্পত্তি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য জামায়াত ডিএমসিএল এর বোর্ড চেয়ারম্যান শিব্বির মাহমুদ ও খন্দকার জাাকির হোসেনের ওপর নানাভাবে চাপ দিচ্ছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিকুল পরিবেশের কারণে দিগন্ত মিডিয়া পরিচালনা থেকে সরে যাওয়া ইবনে সীনা ট্রাস্টকে আবারও পত্রিকা পরিচালনায় যুক্ত করার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। তারই অংশ হিসেবে ইবনে সীনার পরিচালক কাজী হারুনুর রশীদ ও আবদুস সাদেক ভূঁইয়াকে নতুন করে ডিএমসিএল এর পরিচালক করার চেষ্টা করছে জামায়াত। এছাড়াও ইবনে সীনার ব্যানারে জামায়াতের অর্থ যোগানদাতা মেজবাহ উদ্দিন সাঈদসহ আরো কয়েকজন ব্যবসায়ীকে পরিচালক বানিয়ে ডিএমসিলের বিকল্প ব্যবস্থাপনা কর্র্তৃপক্ষ তৈরি করে দিগন্ত মিডিয়ার সকল সম্পত্তি দখলে জামায়াতের নেয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছে বলে সূত্র জানায়।
নয়া দিগন্ত দখল ও দিগন্ত মিডিয়ার সকল কর্তৃত্ব সম্পত্তি দখলে নেয়া নিয়ে ডিএমসিএলর বর্তমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধ এখন তুঙ্গে। এই বিরোধ সংঘাত-সংঘর্ষ ও মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ানোরও আশংকার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
নয়া দিগন্তের একাধিক সাংবাদিক ও কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তবে নাম প্রকাশে কেউ রাজি হননি। তারা জানান, দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলী জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতার দায়িত্বে থাকলেও নয়াদিগন্ত ও দিগন্ত টিভিকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে দেননি। তিনি দলমত নির্বিশেষ সবার কাছে একটি গ্রহনযোগ্য মিডিয়া গড়ার অংশ হিসেবে নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত টিভিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে গেছেন। এজন্য জামায়াত বরাবরই তার ওপর নাখোশ ছিল। এমনকি এ জন্য তার পদ পদবিও কেড়ে নেয়া হয়েছিল। তখন জামায়াতের সাংগঠনিক চ্যানেলে নয়া দিগন্ত পত্রিকা যাতে না কেনা হয় তার জন্য সাংগঠনিক আদেশও জারি করা হয়েছিল।
এদিকে ২০১২ সালে মীর কাসেম আলী গ্রেফতার হওয়ার সময় বর্তমান চেয়ারম্যান শিব্বির মাহমুদকে দিগন্ত মিডিয়ার হাল ধরার দায়িত্ব দিয়ে যান। সে থেকে তিনি প্রথমে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমানে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে নয়া দিগন্তের ডিক্লারেশনে শামসুল হুদা এফসিএ এর নাম ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এই পত্রিকার আর্থিক দায় দায়িত্বসহ কোন কিছুর সাথে সম্পৃত্ত না থাকলেও এই দ্বিতীয়বারের মতো গত ৩ ফেব্রুয়ারি নিজেকে পত্রিকার মালিক দাবি করে অচলাবস্থা তৈরি করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জামায়াত নেতাদের প্রভাবেই তিনি এই কাজটি করেছেন বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগেও ২০১৬ সালেও এভাবে একবার নিজেকের পত্রিকার মালিক দাবি করে চিঠি ইস্যু করে ব্যবস্থাপনা কাজে জটিলতা তৈরি করেছিলেন। জানা যায়, ডিএমসিএল কিংবা নয়া দিগন্তে শামসুল হুদার কোন বিনিয়োগ নেই। তাকে অনারারি পরিচালক করে তার নামে পত্রিকার ডিক্লারেশন নেয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে জানার জন্য ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি।
জানাগেছে, মীর কাসেম আলীর মৃত্যু দন্ড কার্যকর হওয়ার পর তার নিয়ন্ত্রন ও পরিচালনাধীনে থাকা সকল সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তরের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।