নিজস্ব প্রতিবেদক :
মাদকের কালো ছায়ায় অন্ধকার আশুলিয়ার ইয়ারপুর। এখানে মাদকের স্পট রয়েছে ৫০-র ওপরে। আর মাদক ব্যবসায়ী আছে প্রায় শতাধিক।
এদের মধ্যে ধর্মীয় লেবাস লাগিয়ে হুজুর সেজে বাবা-ছেলের মাদক সিন্ডিকেটটি সবচেয়ে বড়। এই সিন্ডিকেটের মূল হোতা নাজমুল ওরফে হুক্কা নাজমুল, সেকেন্ড ইন কমান্ড আলী জিন্না ওরফে জামাই জিন্নাহ। তারা দুজনেই পিতা পুত্র। এদের অন্যতম সহযোগীরা হলেন, সালমান আহমেদ মনির ওরফে টোকাই মনির, রুবেল ওরফে সেক্সি রুবেল, ফারুক ওরফে পাগলা ফারুক, সালাউদ্দিন ওরফে ফিটিং সাল্লু, হায়দার ওরফে গাংগুয়া, মেহেদী ওরফে বাঁশ তলার গাঞ্জু মামু, আব্দুল্লাহ ওরফে পিনিক আব্বা, বাদল ওরফে ডিস বাদল।
এছাড়াও এদের খুচরা ব্যবসায়ীর সংখ্যা আরও তিনগুণ বেশি। শর্টকাট ফর্মুলায় ধনী হওয়ার আশায় অনেক তরুণ ও নারীও এ পেশায় ঝুঁকছেন। মরণ নেশা গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, আইসপিল, টিডিজেসিক ও লুপিজেসিক ইঞ্জেকশনসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্যে সয়লাব হয়ে গেছে আশুলিয়ার ইয়ারপুর। বিভিন্ন সমীক্ষালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, সাভার উপজেলায় প্রায় ১ লাখ মাদকসেবী রয়েছে। বছরে তারা প্রায় ১৫০ কোটি টাকার মাদক গ্রহণ করেন। এরমধ্যে শীর্ষস্থানে রয়েছে ইয়ারপুর ইউনিয়ন।
মাদকের বিষাক্ত ছোবলে হাজার হাজার তরুণের জীবন বিপন্ন। মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও খুনসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। মাদকসংক্রান্ত দ্বন্দ্বে খুনের ঘটনা তো রয়েছেই। এ ছাড়া সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে প্রায় হাজার খানেক। মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও রাঘব-বোয়াল পিতা-পুত্রের এই সিন্ডিকেট রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরেই।
মাদকের রুট:
সড়ক পথে এ এলাকায় অবাধে মাদকদ্রব্য আসে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন কর্মকর্তা। মাদক প্রবেশের সবচেয়ে নিরাপদ রুট হচ্ছে বিশমাইল বিশ্বরোড ও জামগড়া রোড। এই সড়ক ব্যস্ততম হওয়ায় মাদকব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে মাদক আনা-নেয়া করেন। এ ছাড়া ঢাকা আরিচা মহাসড়ক, নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়ক, ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়ক ও বিরুলিয়া ব্রিজ হয়ে মাদক ঢোকে আশুলিয়ায়। ইয়ারপুর ইউনিয়নের কুন্ডলবাগ ও ঘোষবাগ হচ্ছে মাদকের ট্রানজিট পয়েন্ট।
আখাউড়া, সিলেট ও ব্রাক্ষণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক বাস, নাইট কোচ, সংবাদপত্র বহনকারী মোটরসাইকেল কিংবা ট্রাকযোগে ওই এলাকায় আসে। আর এখান থেকে নিরাপদে মাদক সেবীরা পেয়ে যায় হাতের নাগালে।
পাচারের নানা কৌশল:
পুলিশ ও মাদক ব্যবসায়ীদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায়ীরা নানা কৌশলে মাদক বহন করে থাকেন। ইয়াবা ও ফেনসিডিল বহন করা হয় লাউ, নারিকেল আর ম্যাচের বাক্সের ভেতরে করে। হেরোইন বহন করা হয় মিষ্টির প্যাকেটের ভেতরে। আর গাঁজা বহন করা হয় ছালার চটের ভেতরে করে।
মাদক বহনের কাজে ব্যবহার করা হয় শিশু-কিশোরদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহিলাদের দিয়ে মাদক বহন করা হয়। মহিলাদের স্পর্শকাতর জায়গায় ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা রেখে বহন করা হয়। মাদক ব্যবসায় পিতা-পুত্র সিন্ডিকেটে ১০০-র বেশি শিশু-কিশোর সেলসম্যান রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।
মাদকের আখড়া:
আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইয়ারপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের কুন্ডলবাগ, ঘোষবাগ, আসকর হাজির বাঁশতলা, বালির মাঠ বাউন্ডারি, পিনিক টাওয়ার এলাকা মাদকের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এখান থেকে পুরো ইউনিয়নজুড়ে মাদকে সয়লাব।
মাদকে আসক্ত ১৫ হাজার শ্রমিক:
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানার ৪ টি ইউনিয়নে ছোট-বড় প্রায় ৭ হাজার শিল্পকারখানা রয়েছে। এ সব শিল্পকারখানায় রয়েছে কয়েক লাখ শ্রমিক। এ সব শ্রমিকের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক নেশায় জড়িয়ে পড়েছে। এ সব শ্রমিক সবাই বহিরাগত। এরা ছোট ছোট খুপরি ঘরে কিংবা মেস ভাড়া করে ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছে। এ সব খুপরি ঘরে মাদক ব্যবসায়ীরা ফেরি করে নেশা বিক্রি করে বলে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক জানান।
সন্ধ্যার পরপরই মাদক ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বহিরাগত ও ঘনবসতি থাকায় গার্মেন্টস এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মামলা ও গ্রেপ্তার:
ঢাকা জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গেল বছরের শেষ চার মাস ও চলতি বছরের প্রথম এক মাসে র্যাব, ডিবি ও থানা পুলিশ ২০০ মামলা করেছে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। আর এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার ও বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করা হয়েছে। তবে আশুলিয়ার সিন্ডিকেট প্রধান কৌশলী নাজমুল ওরফে হুক্কা নাজমুল ও আলী জিন্না ওরফে জামাই জিন্নাহ রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের সহযোগীরা অনেকে গ্রেফতার হলেও জামিনে বের হয়ে পুনরায় লিপ্ত হয়েছে এই অপকর্মে।
প্রশাসনের বক্তব্য:
আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান নিয়মিত চলে। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে পুলিশ। কোন মাদক ব্যবসায়ী আশুলিয়া থানা এলাকায় থাকতে পারবে না, সেই রূপ রেখা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারী ঢাকা জেলা পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা বলেন, সাভার ও আশুলিয়ায় মাদক মাকড়সার মতো ছড়িয়ে গেছে। এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে তবে যারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।