মোঃ শফিকুল ইসলাম, গৌরনদী (বরিশাল) প্রতিনিধি ||
বহু বছর পর ভোটে মেতেছে বরিশালের মানুষ। সাত উপজেলার নির্বাচন ঘিরে জমজমাট ভোটের মাঠ। প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি মিলছে নিত্যনতুন চমকের দেখা। বিএনপিবিহীন নির্বাচন জমবে না ভাবা হলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। একে অপরের বিরুদ্ধে নামা আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই জমিয়েছেন নির্বাচন। এতে করে অবশ্য ক্ষমতাসীন দলে বাড়ছে বিরোধ। নেতায়-নেতায় ভাগ হয়ে পড়ছেন কর্মী-সমর্থকরা। যদিও এ নিয়ে তেমন ভাবনা নেই ভোটারদের। সুষ্ঠু নির্বাচন আর ভোটের লড়াইয়েই আগ্রহ তাদের। নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তিও আছে ক্ষমতাসীন দলে। দলীয় প্রতীক আর সমর্থন না থাকায় বিপাকে পড়েছেন অনেকে। বিশেষ করে এমপি-মন্ত্রী আর প্রভাবশালী নেতারা। স্থানীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নে নিজস্ব কেউ জিতুক, চাইছেন তারা। তবে মুখ ফুটে কেউ বলতে পারছেন না কিছু।
গৌরনদী : প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপির নির্বাচনি এলাকা এটি। পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক পদে আছেন এই নেতা। এতদিন তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল এখানে। কিন্তু এবার তিনি একেবারেই চুপ। সমর্থন প্রশ্নে বলছেন না কিছুই। ২৯ মে অনুষ্ঠিত হবে এখানকার নির্বাচন। চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ৩ জন। পৌর মেয়র পদ থেকে পদত্যাগ করে ভোটে নামা হারিছুর রহমান (মোটরসাইকেল), বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুন নাহার মেরী (আনারস) এবং পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি মনির হোসেন (কাপ-পিরিচ)। শুরু থেকেই নিজেকে হাসানাতের প্রার্থী দাবি করে আসছেন হারিছ। অন্য দুজন অবশ্য তা বলছেন না। তাদের টার্গেট ‘হারিছ ঠেকাও’। এই ইস্যুতে তারা বেঁধেছেন জোট। মনিরকে সমর্থন দিয়ে সরে দাঁড়িয়েছেন মেরী। মেরী বলেন, ‘মেয়র থাকাকালে চাঁদাবাজি-সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়েছেন হারিছ। যে কারণে তাকে ঠেকাতে মনিরকে সমর্থন দিয়েছি।’ মেরী-মনিরের এই সমঝোতাকে অবশ্য পাত্তা দিচ্ছেন না হারিছ। বিষয়টিকে জামানত বাঁচানোর চেষ্টা বলছেন তিনি। তার ভাষায়, আমার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলেই তারা জোট বেঁধেছে।’
বানারীপাড়া : এই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে ৩ জন দাখিল করেছিলেন মনোনয়ন। এরা হলেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাওলাদ হোসেন সানা এবং সহসভাপতি জিয়াউল হক মিন্টু। ৫ জুন অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ বৃহস্পতিবার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান মিন্টু। গোলাম ফারুককে সমর্থনের ঘোষণা দেন তিনি। ফলে বদলে গেছে এখানকার নির্বাচনি হিসাব। গোলাম ফারুকের পরিচিতি এমপি হাসনাত আব্দুল্লাহ’র ঘনিষ্ঠজন হিসাবে। প্রচার-প্রচারণায়ও তার কথা বলছেন ফারুক। পক্ষান্তরে ফারুকের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলছেন সানা। সানা বলেন, ‘তিনি (ফারুক) সন্ত্রাস করে ভোটে জিততে চাইছেন।’ গোলাম ফারুক বলেন, ‘জনসমর্থনের শক্ত ভিত না থাকলেই এসব মিথ্যা অজুহাত তোলে মানুষ।’
হিজলা : দুই এমপি পঙ্কজ দেবনাথ ও ড. শাম্মি আহম্মেদ’র (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচনি এলাকা হিজলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী নিয়ে দুই এমপির মধ্যে চলছে বিরোধ। কেবল উপজেলা নির্বাচন নয়, পঙ্কজ-শাম্মির এই বিরোধ চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা জানান, ২১ মে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে এমপি পঙ্কজের সমর্থন পাচ্ছেন নজরুল ইসলাম রাজু ঢালী। এমপি শাম্মির প্রার্থী হিসাবে শোনা যাচ্ছে আলতাফ মাহমুদ দিপু সিকদারের নাম। তার বড় ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান টিপু সিকদারও হয়েছেন প্রার্থী। স্থানীয় রাজনীতিতে এমপি হাসানাতের অনুসারী হিসাবে পরিচিত টিপু। তবে যথারীতি নীরব হাসানাত। ছোট ভাই ভোটে নামায় ক্ষিপ্ত টিপু। তিনি বলেন, ‘ও তো (দিপু) বিশাল সন্ত্রাসী। এখানে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে।’ বড় ভাইয়ের এই মন্তব্যের বিপরীতে কিছু বলতে রাজি হননি দিপু।
মুলাদী : ২১ মে অনুষ্ঠিত হবে এই উপজেলার ভোট। চেয়ারম্যান পদে ৩ জন থাকলেও আলোচনায় আছেন দুজন। এরা হলেন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তারিকুল হাসান খান মিঠু এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জহির উদ্দিন খসরু। দুজনের মধ্যে নিজেকে হাসানাত আব্দুল্লাহর প্রার্থী বলে দাবি মিঠুর। খসরু বলেন, ‘তিনি (মিঠু) কীভাবে নিজেকে এমপি হাসানাত সাহেবের প্রার্থী বলেন আমি জানি না। কেননা হাসানাত আব্দুল্লাহ তো আমারও নেতা। ভোট সুষ্ঠু হলে আমি জয়ী হব ইনশাল্লাহ।’ মিঠু খান বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান হিসাবে আমার কাজের মূল্যায়ন করবে মানুষ। তারাই আবার আমাকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন।’
বাবুগঞ্জ : বরিশাল নগরের উপকণ্ঠে থাকা এই উপজেলায় ৫ জুন হবে নির্বাচন। অনেকে রসিকতা করে বলছেন ‘পুলিশ আর সর্বহারার ভোট’। এখানে দুজন প্রার্থীর একজন ছিলেন একসময় সর্বহারা পার্টির নেতা। আর অন্যজনের স্বামী পুলিশের বড় কর্মকর্তা। চেয়ারম্যান পদের এই দুই প্রার্থী হলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সরদার খালিদ হোসেন স্বপন এবং বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী ফারজানা বিনতে ওয়াহাব। স্বপনের অভিযোগ, ফারজানা’র স্বামী একজন পুলিশ সুপার। তিনি বিভিন্নভাবে আমার কর্মী সমর্থকদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছেন। আমি এ ব্যাপারে ট্যুরিস্ট পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’ অভিযোগের জবাবে ফারজানা ওয়াহাব বলেন, ‘আমার স্বামীর পোস্টিং কুয়াকাটায়। তিনি বাবুগঞ্জে আসেন না। নির্বাচনে পরাজয় নিশ্চিত জেনে তিনি (স্বপন) এসব উলটা-পালটা বলছেন। তাছাড়া স্বপন সন্ত্রাস ছড়াচ্ছেন। নানা অপরিচিত মুখের আনাগোনা বেড়েছে। একসময়ের সর্বহারা নেতা স্বপন সর্বহারা সন্ত্রাসীদের দিয়ে ভোটের মাঠ দখল করতে চাইছেন।’
আগৈলঝাড়া : বরিশালের উজিরপুর এবং আগৈলঝাড়া উপজেলাতেও চলছে নির্বাচনি প্রচার প্রচারণা। ২৯ মে আগৈলঝাড়া এবং ৫ জুন উজিরপুরে অনুষ্ঠিত হবে ভোটগ্রহণ। এর মধ্যে উজিরপুরে ৫ জন এবং আগৈলঝাড়ায় ২ জন প্রার্থী লড়ছেন চেয়ারম্যান পদে। চলমান উপজেলা নির্বাচনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপকালে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি বলেন, ‘উৎসবমুখর পরিবেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে কাজ করছেন আমাদের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলমত নির্বিশেষে সবাই যাতে ভোট দিতে যায় সেজন্য দলীয় সমর্থন আর প্রতীকও উঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার নির্দেশনা অনুযায়ী আমি এবার আর কাউকে সমর্থন দিচ্ছি না। এখানে ভোটারদের সিদ্ধান্তই আমার কাছে চূড়ান্ত।’