আশুলিয়া (ঢাকা) প্রতিনিধি : ঢাকার আশুলিয়া থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে পদায়িত হয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ডাবলু। তবে নিয়োগের পরপরই তাকে নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক।
ছড়িয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০২২ সালে এক এমপির ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ২০২৪ সালে ছাত্রদলের এক সুপারিশপত্র হয়েছেন। দুটি সুপারিশপত্রের ভাষাও একই রকম দেখা যায়। যেখানে একটিতে ঢাবিতে পড়াকালে তিনি ছাত্রলীগের দুঃসময়ের কর্মী ছিলেন আর অপরটিতে তিনি ছাত্রদলের দুঃসময়ের কর্মী ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি সোমবার (৩ মার্চ) রাতে জানাজানি হয়।
এর আগে, রোববার (২ মার্চ) ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার সাক্ষরিত অফিস আদেশে এ পদায়ন করা হয়।
এতে দেখা যায়, গত ৯ জানুয়ারি এক আদেশে গত ১২ জানুয়ারি ঢাকা জেলা পুলিশে যোগ দেওয়া পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ডাবলুকে আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তার বিপি নম্বর- (৭৮০৬০৯৮৫২১)।
মো. মনিরুল ইসলাম ডাবলু রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থানার বাহাদুরপুর এলাকার মৃত আ. জলিল মিয়ার ছেলে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
দুটি সুপারিশপত্রের একটিতে (২০২২) ডাবলুকে ঢাবিতে পড়াকালীন ছাত্রলীগের দুঃসময়ে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। অপরটিতে (২০২৪) ডাবলুকে ঢাবিতে পড়াকালীন ছাত্রদলের হাজী মুহাম্মদ মহসিন হল কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি তার সাক্ষরিত এক সুপারিশপত্রে লিখেন, ডাবলু ঢাবির মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ফলাফল করে উত্তীর্ণ হন। এছাড়া ছাত্রলীগের লিয়াকত-বাবু কমিটিতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মুজিব সৈনিক ও শেখ হাসিনার নির্ভিক কর্মী। তিনি নিউমার্কেট থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) হিসেবে কর্মরত আছেন।
অপরদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মহসিন হল কমিটির প্যাডে ২০২৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আরেকটি সুপারিশপত্রে লেখা হয়, ডাবলু ঢাবির মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ফলাফল করে উত্তীর্ণ হন। এছাড়া জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মেজবাহ-ইউনুস কমিটিতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাজী মুহাম্মদ মহসিন হল) কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মী হিসেবে দুঃসময়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ সৈনিক। তিনি পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) হিসেবে ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটায় কর্মরত আছেন।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিতর্ক ছড়িয়ে পড়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু তৌহিদ মো. সিয়াম লিখেছেন, আশুলিয়া থানাতে লীগের এক ক্যাডারকে বসানো হইছে ওসি হিসেবে। কত টাকা খেয়ে কে এই কাজ করছে এইটার জবাব ইন্টেরিমকে দিতে হবে। যেই আশুলিয়াতে ৫ আগস্টের পরও মানুষের রক্ত ঝরেছে, সেই আশুলিয়াতে এই লীগের ক্যাডারকে কারা কোন ক্ষমতাবলে নিয়োগ দিলো এটার জবাব ইন্টেরিমকে দিতে হবে।
তিনি আরও লিখেন, অতি দ্রুত এই লীগের ক্যাডারকে অপসারণ করেন। অন্যথায় আশুলিয়ার ছাত্র জনতা আবারও রক্ত দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিবে। ইন্টেরিম সাবধান। খুব সাবধান।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আলকামা আজাদ তার ফেসবুক পোস্টে লিখেন, ইন্টেরিম গভর্নমেন্টের ওপর থেকে সকল আস্থা তুলে নিলাম। সংস্কার দরকার নাই, নির্বাচন দেন ক্ষমতা ছাড়েন।
তিনি আরও লিখেন, যেই সাভার-আশুলিয়াতে প্রতিদিন রাজপথে মানুষ মরেছে ঝাঁকে ঝাঁকে। সেই এলাকায় আপনারা আওয়ামী দলীয় ক্যাডারকে ওসি নিয়োগ করে কাদের সঙ্গে মশকরা করেন? লজ্জা করে না?
মনিরুল হক ডাবলুর রাজনৈতিক পরিচয় জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হাজী মুহাম্মদ মুহসিন হলের সভাপতি একেএম মেজবাহ উদ্দীন সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, উনি আমার হল কমিটিতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন । আমরা এক সাথে রাজনীতি করেছি। তখন সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ভাই, ডাবুল ও আমরা এক সাথে রাজনীতি করছি।
মনিরুল হক ডাবলুর ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ততা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, না, তার সাথে ছাত্রলীগের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি হলফ করে বলতে পারি ছাত্রলীগের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নাই।
এ সময় মেজবাহ উদ্দিন আরও বলেন, ২০০১ সালে মহসিন হলের দখলে ছিল ছাত্রলীগের শফিকরা। তখন ডাবলু, আনিস, হিরু আমরা এক সাথে ছাত্রদলের রাজনীতি করেছি। তখন আমাদের উপর অনেক নির্যাতন করা হয়েছে। আমি জেল খেটেছি। আরও অনেক অত্যাচার করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের এক সংসদ সদস্যের দেয়া ছাত্রলীগের প্রত্যয়ন পত্রের ব্যাপারে তিনি জানান, এ গুলো ভূয়া। আমি মহসিন হলের সভাপতি আমি ছাত্রদল করছি, ডাবলু ছাত্রদল করছে। সবচেয়ে ভালো বলতে পারবেন আমাদের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ভাই। আপনি উনাকে ফোন করেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে সাবেক এই ছাত্রদল নেতা ও বর্তমান বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তা সম্ভব হয়নি।
বিতর্কের বিষয়ে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম ডাবলু বলেন, আওয়ামী লীগের প্যাডে যেটা বানাইছে, ওটা হলে তো আমি বড় বড় জায়গায় ওসিগিরি করতে পারতাম। ট্যুরিস্ট পুলিশে ছিলাম। তার আগে ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে ছিলাম। আমি জীবনে একটা ভালো পোস্টিং পাই নাই। জাস্ট আশুলিয়া ছয় মাস ছিলাম। তাও ছাত্রলীগের তিনটারে মারছিলাম। তৎক্ষনাৎ সিআইডিতে দিয়ে দেয়। একটা দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যেতে অনেক বছর রাজনীতি করতে হয়। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
আমি ওসি হওয়ার পর আদালতে ছিলাম, তারপর আশুলিয়া, এরপর সিআইডিতে গেলাম। তারপর ডিএমপি কোর্ট ইন্সপেক্টর। এরপর উত্তরা পূর্ব থানায় ৯ মাস, নিউমার্কেট থানায় অপারেশন ওসি ছিলাম। এরপর আমি যাই ঢাকা রেঞ্জে। সেখানে পোস্টিং না দিয়ে লাইনে রাখলো, অমানবিকতার চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিলাম। এরপর ট্যুরিস্ট পুলিশে দিলো রিমোট হিসেবে। তখন ছিলাম কুয়াকাটা, এরপর ট্যুরিস্ট সাভার-আশুলিয়া। এরপর মাসখানেক আগে ঢাকা রেঞ্জে এলাম। তারপর আশুলিয়া থানায় পেলাম।
যে দুটি সুপারিশ আছে, এরমধ্যে একটি সত্য। ছাত্রলীগের যে দাবি সেটি অসত্য। যদি এমন হতো, তাহলে ঢাকার ভালো থানায় ওসিগিরি করতে পারতাম। এগুলো ফেক (ভুয়া)। আমি তখন তদন্ত ওসি হতে পারিনি। ওসি তো দূরের কথা।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আনিসুজ্জামানের বক্তব্য নিতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও রিসিভ করেননি।